জীবনে অসহায় অবস্থা উপভোগ করার একটু অন্যরকম আনন্দ আছে। আপনি যখন অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়বেন তখন অন্য কারো অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করবেন যে ব্যক্তি আপনার চেয়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছিল। তাহলে আপনার নিজেকে কখনও অসহায় মনে হবে না এবং স্রষ্টাকে অনেক বেশি ধন্যবাদ দিতে পারবেন।
২০১৫ সালের ৮ই মে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছিলাম আমি। শুধু আমি নই। আমরা ছিলাম তিনজন। আমি, এহসানুর রশীদ এবং মুবিনুল হক। এহসান এবং মুবিনুল চট্টগ্রামের মানুষ। এহসান সরকারি নাসিরাবাদ কলেজে প্রথম বর্ষে পড়তো। আর বায়তুশ শরফ মাদ্রাসায় পড়তো মুবিনুল হক। দুজনই কোরআনের হাফেজ। এহসানের মা অসুস্থ ছিলেন। নিয়মিত কেমোথেরাপি চলছিল তাঁর। তবুও চট্টগ্রাম জেলা আদালতে ছেলেকে দেখতে এসেছিলেন তিনি। হাসান ভাই (এহসানের বড় ভাই) তার মাকে সান্তনা দিয়েছিলেন, "দেখেন মা, ইসলামুলের বাড়ি অনেক দূরে। ওর বাড়ি থেকে কেউ আসতে পারেনি। অথচ ও কোনো দুশ্চিন্তা করছে না। বরং আপনাকেই সান্ত্বনা দিচ্ছে।" এহসানের মায়ের সাথে কথা বলেছিলাম। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন শুধু। জলে ভরে উঠেছিল দু'চোখ। এহসানের চোখ থেকেও অশ্রু গড়িয়ে পড়েনি সেদিন। তবে হৃদয়টা কেঁদেছিল সবার।
কারাগারে হালদা ১৭-তে থাকতাম আমরা। একটানা ১৭ দিন এক কাপড়ে ছিলাম। তারপর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তাওহীদ ভাই আমাকে একটা লুঙ্গি এবং গামছা দিয়েছিলেন। হালদা ১৭-তে কিছুদিন থাকার পর আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল ৩২-সেলের ১৪ নম্বর কক্ষে। পরে দুই দিনের রিমান্ড হয়েছিল আমাদের।
আমি আর এহসান কর্ণফুলীর নীচতলায় ক্যান্টিনের সামনে দেখা করতাম প্রতিদিন। কিছুদিন পর সেটাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
চট্টগ্রামে নাজমুল, রানা, দিপু, রাশেদ ভাইদের মত বন্ধু ছিল না। তাই কোনো বন্ধু সেদিন দেখা করতে আসেনি। তবে একজন শরিফ ভাই ছিলেন, একজন মাসুম ভাই ছিলেন। আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন কারাগারে। আরো কে একজন দেখতে গিয়েছিল শরীফ ভাইয়ের সাথে -তার কথা মনে নেই।
কারাগার থেকে বের হওয়ার কয়েকদিন আগে এহসানের স্যান্ডেল চুরি হয়ে গিয়েছিল -এদিকে আমারটাও। অবশেষে, যেদিন আমরা কারাগার থেকে বের হচ্ছিলাম, আমার পায়ে স্যান্ডেল না দেখে তাওহীদ ভাই তার স্যান্ডেল আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। তখন এহসানের জন্য স্যান্ডেলের ব্যবস্থা করা যায়নি। আমাদের কাছে কোন টাকা ছিল না। তাওহীদ ভাইয়ের কাছেও ছিল না। কারাগার থেকে বের হওয়ার পর দেখলাম অনেকে এসেছে তাদের স্বজনকে নিয়ে যেতে। মুবিনুল হকের আত্মীয়-স্বজনসহ সবাই এসেছে। এহসানের পরিবার থেকে কেউ আসেনি। তার মা অসুস্থ ছিলেন। সবাই হয়তো সেদিকে ব্যস্ত ছিল তাই আসতে পারেনি। কারাগার থেকে বের হয়ে এহসান যখন দেখল যে, তার পরিবার থেকে কেউ আসেনি তখন প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেয়েছিল সে। পরক্ষণেই আমাকে দেখে নিজেকে সামলে নিয়েছিল ও। আমরা কিছু সময় অপেক্ষা করেছিলাম। মুবিনুল হককে নিয়ে তার স্বজনদের কান্নাকাটি চলছিলো। আমাদের কেউ আসেনি দেখে মুবিনুলের বড় ভাই আমাদেরকে তাদের বাসায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমরা বলেছিলাম, "কোন সমস্যা নেই। আমরা একাই চলে যেতে পারবো।" তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমাদের কাছে টাকা-পয়সা আছে কি-না। জবাবের অপেক্ষা না করেই তিনি আমাদেরকে ৫০০ টাকা দিয়ে দিলেন। এরপর তারা চলে গেলেন আর আমরা নিউ মার্কেটের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তা ছিল প্রচন্ড উত্তপ্ত। এহসানের পায়ে স্যান্ডেল না থাকায় খুব কষ্ট পাচ্ছিল ও। আমার সেন্ডেল ওকে দিতে চাইলাম কিন্তু ও নিল না আমার কষ্ট হবে বলে। লালদীঘির ময়দান পেরিয়ে নিউ মার্কেটের দিকে কিছুদূর গিয়ে একজোড়া স্যান্ডেল কিনলাম এহসানের জন্য। তারপর এহসানকে একটা সিএনজি-তে উঠিয়ে দিলাম। লালখান-বাজারে ছিল ওদের বাসা।
এহসানকে বিদায় দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। শহরের কত পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন ঘটেছে মানুষের। চারিদিকে কত আলো আর বাতাস। উন্মুক্ত আকাশ। নিউ মার্কেট পৌঁছে একটা বাসে উঠলাম ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। বাস চলতে শুরু করল। সেদিন ছিল শুক্রবার। তাই রাস্তা ছিল ফাঁকা। জানালায় মাথা রেখে তাকিয়ে রইলাম আকাশের দিকে। আকাশটা কত উদার। মনে হলো এমনি করে যদি অনন্তকাল চলতে পারতাম, এ পথের যদি কখনো শেষ না হতো........
[কয়েক বছর পর লেখাটি লিখতে গিয়ে চোখ ভিজে এল। আমি যখন কারাগারে ছিলাম তখন আমার ভাই ছিল মুমূর্ষু অবস্থায়। বসন্ত হয়েছিল ভাইয়ের। কারাগারে থাকতে খবরের কাগজে পড়েছিলাম আমাদের এলাকায় বসন্ত রোগে তিনজন মারা গেছে।]